মানুষের জীবনে সবচাইতে মূল্যবান যে জিনিসটি প্রচন্ড অবহেলায় চোখের সামনে দিয়ে বিশ্মৃতির অতল সমুদ্রে তলিয়ে যায় সেটি আর কিছু নয়- সময়। মানুষের জীবনকে বিভিন্ন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ হয়তো রয়েছে। আমাকে যদি তেমন কোন সুযোগ দেয়া হয় তবে আমি তাকে যেভাবে বলবো তাহলো, সময়ের সাথে এক নির্দিষ্ট পরিক্রমা যার মাধ্যমে তার করণীয় সম্পন্ন করার প্রয়াস।
এই সময়ের পরিক্রমায় তিল তিল করে সময় বয়ে যাচ্ছে- কোনই কাজে আসছে না, কোন কিছুই হচ্ছে না। কত জায়গায়-ই তো চেষ্টা করলাম চাকরীর জন্য- কিন্তু কোথায় সেই সোনার হরিণ? আর কতটা দিন এভাবে অপেক্ষার দিন গুনতে থাকবো? জীবনের বিগত দিনগুলোর সমস্ত কষ্ট-দুঃখ একটা আশায় অতিক্রান্ত হয়েছে। শান্তনা পেতে চেষ্টা করেছি যে সময় এমনটি থাকবে না সর্বদা- অবশ্যই বদলাবে। এই বদলানোর জন্য চেষ্টা এবং অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই অপেক্ষার সময় শেষ হয়েছে বলে যখন মনে করলাম তখন থেকেইতো শুরু করলাম দিন বদলের দিনগুলোকে খুঁজে পেতে। কিন্তু কোথায় সে দিন, আর কতটা অপেক্ষা করতে হবে তার জন্য- ক্লান্তিতে যেনো থেমে যেতে চায় চলার গতি।
গতি! একটু হাসি আসলো। কষ্টের হাসি। হাসিটা কষ্টের হলেও তার সৌন্দর্যের প্রকাশ আজও তেমনই রয়ে গেছে যেমন ছিল তারুণ্যের সেই দূরন্ত দিনগুলোতে। এই হাসি দিয়েইতো একদিন শুরু হয়েছিল সোহানার সাথে সম্পর্কটা, যার মাধূর্য আজও হৃদয় থেকে হারিয়ে যেতে পারে নি যেমনভাবে হারিয়ে যায়নি আজও যৌবনের দিনগুলো, যদিও সেই দূরন্তপনা আজ আর নাই, যা ছিল সেই সময়।
জুনিয়র হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে স্কুল লাইব্রেরী থেকে নিয়ে প্রথম যে উপন্যাসটা পড়েছিলাম সেখান থেকেইতো মনের এক কোনে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতির উপস্থিতি সব সময় টের পেতাম, যা আমার সারা হৃদয়জগতে খেলা করে বেড়াতো। হ্যাঁ, খেলা করেই বেড়াতো কিন্তু খেলাতে কখনো পারে নি। আপনা আপনিই খেলতে খেলতে কখনো কখনো ক্লান্ত হয়ে গেছে। কখনো বা আপন খেয়ালেই কল্পনার ফানুশ উড়িয়ে আনন্দে উদ্বেল হয়েছে। কোন এক অনাগত দিনের প্রতিক্ষায় নীল নীল স্বপ্ন দেখেছে জেগে জেগেই।
না, নাটক সিনেমার নায়কের মতো কোন চৌকশ যোগ্যতা আমার কখনোই ছিল না, যা কাউকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতে পারে। আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই খুবই সাধারণ ক্যারেক্টার এবং চালচলন। নিজের চাতুরতা এবং কেতাদূরস্ততা দিয়ে কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে না কোন দিনই। আর রংচং লাগিয়ে অতি আকর্শনীয় করে প্রকাশ করতে পারে না ভিতরে যা আছে।
গ্রামের এক মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে জীন্দেগীর শুরু এবং বেড়ে উঠা। আরও চার ভাই বোনের মাঝে আমার বেড়ে উঠার মাঝে কোন দিনই কোন বৈচিত্র ছিল না। আনন্দে উদ্বেল হবার মতো কোন কিছুই কোন দিন ঘটে নি। আবেগে আপ্লুত হবার মতো কোন কিছু কোন দিনই সামনে আসে নি। সকালে যেমন সূর্য উঠে এবং সারা দিনের পরিক্রমার পরে সন্ধায় আবার চলে যায় আপন গন্তব্যে, ঠিক তেমনই রুটিন জীবন। কেউ কোন দিন কোন বাড়তি আগ্রহ দেখিয়েছে আমাকে নিয়ে এমনটি কখনই দেখি নি। আর তাই জীবনে যে চঞ্চলতা বলে কিছু আছে তা শিখতে পারি নি কোন দিন।
অনেক সময় বাড়িতে এমন অবস্থা থাকলেও নিজে থেকে বাইরে বন্ধু-বান্ধবদের সমন্বয়ে এমন এক জগত গড়ে উঠার সুযোগ থাকে যেখানের চিত্র থাকে আলাদা। কিন্তু আমার বেলায় সে সুযোগও হয়ে উঠেনি। রক্ষণশীল মানষিকতার কারণে এলাকার কোন বন্ধু বান্ধবের সাথে সময় দেয়ারও সুযোগ ছিল না। বন্ধু নামের কারো সাথে মেলা মেশার সুযোগের উপরেও ছিল সেন্সর। আর তাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে নিজেকে উচ্ছল আনন্দের সাথী করে নেয়ার কোন যোগ্যতা আমার নাই বলেই বিশ্বাস জন্মেছে; কারণ এখন ইচ্ছা এবং সুযোগ থাকলেও তা করতে পারি না।
আর তাই প্রথম যেদিন সোহানার সাথে চোখাচোখি সেদিন নিছক অভ্যাস বশতঃ একটু স্মিত হাসি ছাড়া আর কিছুই বলতে পারি নি। হাসি এসে গেছে নিজের অজান্তেই; জানতে পরি নি। যদি জানতাম তবে হয়তো হাসতেও সংকোচ আসতো। এই সোহানাই একদিন হয়ে উঠে আমার জীবনের সবচাইতে বড় আনন্দের উৎস।
জীবনে অনেক কিছু আসে, যা আমাদের কাম্য নয়; আবার অনেক কিছুই মেলে না, যা আমাদের একান্ত কাম্য। কিন্তু অনেক সময় কাম্য নয় এমন কিছুর মাঝে এমন কিছু মিলে যায় যা মানুষ আশাও করতে পারে না, যা হয়ে উঠে জীবনের এক অনন্য সঞ্চয়। আর তখন ঐ অবাঞ্চিত অবস্থাকে আর অপাংক্তেয় মনে হয় না।
নিজের বাড়ি থেকে দূর কোন এলাকায় প্রয়োজনের তাগীদে অর্থনৈতিক দৈনতার কারণে যদি কোন সময় কাউকে অপরিচিত কোন বাড়িতে লজিং হিসাবে থাকতে হয় যে থাকার বিনিময়ে নিজের পড়ালেখার জন্য প্রয়োজনিয় মূল্যবান সময়ের প্রধানতম সময়টা সেই বাড়ির ছেলেমেয়েদের পিছনে ব্যয় করতে হয়, তা কোনদিনই কারো কাম্য হয় না। কিন্তু এরপরেও মানুষ কখনো কখনো এই কাম্য নয় জিনিসটাই হন্যে হয়ে খুঁজে ফেরে জীবনের তাগিদে।
সৌভাগ্য বশতঃ অনেককে অনেকদিন ধরে বলার পরে একদিন মিলে গেলো এক লজিং। খুব বেশী দূরে নয় কলেজ থেকে- পছন্দ হলো জায়গাটা। মেইন রোডের ধারে। একটু সামনেই কৃষি ফার্ম, তার পাশেই জি. কে. সেচ প্রকল্পের আবাসিক এরিয়া যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিকেল বেলায় সেখানের আকর্ষণ প্রতিদিনের। আর একটু ভিতরে গেলে পদ্মার শাখা নদী গড়াই-এর কুল যার দুপাশ সবুজের সমারোহে আকর্ষণীয় সবার কাছে।
লজিং বাড়িতে গিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই কিভাবে যেন অনেকের সাথেই আলাপ হয়ে গেলো যাদের সাথে সময় ব্যায় করতে বেশ ভালোই লাগতো। তাদের মধ্যে সবচাইতে বেশী কাছাকাছি চলে আসলো আঃ কাদের নামের একজন, যে ওখানে আমার মতোই অরেক বাড়িতে লজিং থাকতো। কুষ্টিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় পড়তো। মোটামুটি ওখানের সবার কাছে পরিচিত এবং শ্রদ্ধেয়। আমি সেই সময়ের কথা বলছি, যখন মানুষ দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষদেরকে শ্রদ্ধা করত, সম্মান জানান- তাদের বিরূদ্ধে অপপ্রচারের যন্ত্রটা ততটা কার্যকর হয়ে উঠতে পারে নি
প্রায় প্রতি বিকেলেই আমরা দুজন ঘুরতে বের হতাম। কোনদিন বা এগ্রিকালচারাল ফার্মের ভিতর দিয়ে আরও সামনে সবুজ শ্যামল ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে হেঁটে সময় কাটাতো। কোনদিন ফার্মের ভিতরেই কোন এক নির্জণ কোণে চুপচাপ বসে গল্প করে কাটিয়ে দিতাম বিকেল বেলাটা। মাঝে মাঝে জি. কে. সেচ প্রকল্পের আবাসিক এরিয়ার ভিতরে পুকুরের কিনারে সবুজ ঘাসের উপরে বসে গল্প করতাম। আবার কোনদিন চলে যেতাম আরও দূরে নদীর কিনার ঘেষা সৌন্দর্যের সবুজ গালিচার আহ্বানে সাড়া দিয়ে।
এমনি একদিন আমি এবং আঃ কাদের পুকুর ঘাটের বিপরীত পাশের পাড়ে ঘাসের উপর বসে গল্প করছিলাম হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে। গল্পের বিষয় ছিল এমন যে, একদিন পড়ালেখা শেষ করে যখন চাকরী করতে যাব তখন হয়তো এরকম এক রেসিডেন্স মিলবে, যেখানে থাকবে সুন্দরী স্ত্রীর উষ্ণ উপস্থিতি। দুজনে হাত ধরে সন্ধার আগে গোধূলী বেলায় পুকুর ঘাটের পাশের সরু রাস্তা দিয়ে মৃদু হাসিতে আশেপাশের পরিবেশকে উচ্ছলতায় ভরিয়ে দিয়ে হাঁটাহাটি করব। এরপর একটা সময় আসবে যখন সাথে সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা যোগ হবে। ছোট্ট বাচ্চার মিষ্টি কলকাকলীতে জীবন হয়ে উঠবে আরো মোহনীয়।
দুজন এসব স্বপ্নের কাহিনী খুব মজা করে উপভোগ করছিলাম যার কারণে আমাদের সোনালী হাসি বিকেলের সোনালী রোদের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল, যা এক অপরূপ সৌন্দর্য্য উপহার দিচ্ছিল। এমনি এক মূহুর্তে কয়েকজন মেয়ে হাঁটাহাটি করতে করতে পুকুরের সান বাঁধানো ঘাটে এসে বসলো। হয়তো সেই উচ্ছ্বল হাসি তাদেরকে হাঁটাহাটি বন্ধ করে ঘাটে এসে বসতে নীরবে আহ্বান করেছিল অথবা অভ্যাস বশতঃই প্রতিদিনের মতো সেখানে এসে বসেছিল।
আমরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের সৌন্দর্য্যটাকে বর্ণনা করতে বেশী সচেষ্ট হই, বেশী আগ্রহ পাই। অবশ্যই সবাই স্বিকার করবে যে, মেয়েদের সৌন্দয্যের কোন তুলনা হয় না। আর তাদের নয়নাভিরাম হাসির কথাতো বলাই বাহুল্য। কিন্তু পাশাপাশি ছেলেদের হাসিও যে একেবারে ফেলনা, তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে ছেলেদের কাছে যেমন মেয়েদের হাসি আকর্ষণীয় তেমন মেয়েদের কাছেও ছেলেদের হাসি আকর্ষণীয় হবে এটাই স্বাভাবিক। আর তাই সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমরা দুজন যখন তাদেরকে অতিক্রম করে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলাম তখন পাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠের আওয়াজে একজন বললো, মিষ্টি হাসিতে সুন্দর সন্ধ্যাটাকে ভরিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment