এ পর্যায়ে তোমাকে বলতে ইচ্ছা করছে যে, জীবনে অনেক কিছু আসে যা চাইতেও ভয় করে। আবার এমন অনেক কিছুই পাওয়া যায় না যা পাওয়ার খুব বেশী আশা এবং চেষ্টা করা হয়। তোমাকে আমি প্রথমেই বলেছি আমার জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের কথা। আমি কখনো কোথাও নিজেকে নিয়ে উৎফুল্ল হবার মতো কোন কিছু দেখি নি। দেখিনি অন্য কাউকেও যে, আমাকে নিয়ে সামান্যতমও উৎফুল্ল হয়ে আমাকে আবেগ তাড়িত করেছে। কি পেয়েছি বা কি পায় নি তার হিসাব করার কথা কখনো মনে আসে নি। কারণ, কি পাবার ছিল, কি পাওয়া উচিত তাইতো বুঝতে পারি নি কখনো।
শৈশব, কৈশর এমন কি যৌবনেও সকল না পাওয়ার স্রোতে কি কি পেতে হবে তাও ভুলে গিয়েছি। বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা- স্বপ্নবিহীন সম্ভবত। কিছু স্বপ্ন থাকলেও তা অবশ্যই অস্পষ্ট।
তোমার ব্যাপারে যদি বলি তবে বলতে হয়, তোমাকে চাওয়ার ব্যাপারটা অনেকটা তিল তিল করে বেড়ে উঠার মতো। প্রতিদিন বা নিয়মিত পড়াশুনা করে নিজের জীবন গড়ার মতো। হঠাৎ দেখা, ভাল লাগা, কথা বলা এবং এর পর আরও বেশী ভাললাগা, একসময় একজন আরেকজনের জীবনের সাথে, স্বপ্নের সাথে, কল্পনার সাথে মিশে যাওয়া বা মিলে যাওয়া থেকে ভিন্ন। কিন্তু সোহানার ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। তোমারটা যেমন হাতে গড়ার মতো সোহানার সাথে সম্পর্কটা তেমন নয়- রেডিমেড বা ইন্সট্যান্ট বলতে পারো। দেখা হলো, ভাল লাগলো, কথা হলো, সম্পর্ক তৈরী হলো। দুজনের ভালবাসার দুটা রূপ, দুটা অবস্থা। সোহানা আমার অবহেলিত এবং স্বপ্নহীন জীবনের স্বপ্ন, যা আমাকে জীবনের সৌন্দর্য্যবোধকে আবিষ্কার করতে শিখিয়েছে। আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাষের বৃক্ষ রোপন করেছে।
তোমাকে আমি দেখেছি তোমার কৈশর অথবা তারও আগে থেকে। তোমাকে ভাল লেগেছে তখন থেকে। সেই ভাললাগার সাথে আজকের ভাললাগার মিল নেই। তোমাকে দেখেছি তিল তিল করে বেড়ে উঠতে আমারই চোখের সামনে। আমার ভাললাগারও পরিবর্তন হয়েছে দিন দিন। তোমাকে আমার চাওয়া প্রতিদিনের বেড়ে উঠার মতো যার সাথে মিশে রয়েছে আমার সকল চেতনা। এমনভাবে কেউ কাউকে চেয়েছে কিনা আমার জানা নাই। এমন করে কেউ কখনো একজনের বেড়ে উঠাকে অবলোকন করেছে কিনা তার নিজের জন্য আমি জানি না। এমন করে একটি কিশোরী মেয়েকে সময়ের প্রেক্ষিতে পল্লবিত হতে দেখে কারো হৃদয় উদ্দেলিত হয়েছে কিনা তাও আমি জানি না। কিন্তু আজ তোমাকে আমার জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়ের কথাগুলো বলতে গিয়ে অনুভব করছি কত পার্থক্য চাওয়ার মাঝে।
আমি একটার সাথে অপরটার তুলনা করতে পছন্দ করি নি। শুধু পছন্দ করি না তাই নয়, বরং আমি এটাকে খুবই অরূচীকর মনে করি। ভালবাসা কখনো তুলনা করে না, বা তুলনা করে হয় না। তোমাকে আমার ভালবাসা, আবার সোহানার সাথে আমার ভালবাসা দুটোর উপলব্ধি দুইরকম। কোনটাকেই খাট করে দেখার সাধ্য বা স্পর্ধা আমার নাই; আমি তা চাইও না। তুমি আমাকে চেয়েছো অথবা না চেয়েছো, চাও অথবা না চাও তার হিসাব তোমার কাছে- কিন্তু আমিতো চেয়েছি প্রতিটা পল। তার দাম আমার কাছে অপ্রার্থিব। তুমি আমাকে যদি নাও চেয়ে থাক তবুও আমাকে যে চাওয়ার সুযোগ দিয়েছো সেজন্যও আমি তোমার প্রতি আবেগাপ্লুত।
তোমার কাছ থেকে আমার ভালবাসার সম্মতির জন্য আমার অপেক্ষা প্রতিদিনের, কিন্তু সোহানা আমাকে তখনই তার সম্মতিই শুধু দেইনি, তার হৃদয় আমাকে সমর্পন করেছে, যখন থেকে আমি চাইতে শুরু করেছি মাত্র। কিন্তু এর অর্থ অবশ্যই এও নয় যে তার ভালবাসা আমার কাছে সহজলভ্য। আমি পেয়েছি তখনই যখন থেকে আমি চেয়েছি, কিন্তু তা আমার কাছে সারা জীবনের মূল্যের চাইতেও বেশী, যা আমি আমার ফেলে আসা জীবনে পাই নি। আমার জীবনেরও যে একটা মানে আছে তাতো আমি বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকেই যেদিন সোহানা আমাকে বলেছিল, “আমি আমার সবটুকুই হারিয়ে ফেলেছি তোমার মাঝে শর্তহীনভাবে- তোমাকে বাদ দিয়ে আমার করে আমি কোন কিছুকেই ভাবতে পারি না।”
আমার কি আছে, কি নাই তা সে কখনো ভাবে নি। আমি তাকে কি দিতে পারবো, কি না তাও কখনো ভাবতে দেখি নি তাকে। এমনকি আমি তাকে কতখানি ভালবাসি তাও দেখার চেষ্টা কখনো করে নি। শুধু সে যে আমাকে ভালবাসার অধিকার পেয়েছে এটাই তার কাছে বড়। আমি তাকে ভালবাসি এটা দেখার চাইতে সে আমাকে ভালবাসে এটাই বেশী প্রাধান্য পেত তার কাছে। কিজানি হয়তো সে আমার ভালবাসার ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত থাকতো যে, সেটা আমার মুখ থেকে শোনার বা আমার কাছ থেকে প্রকাশ দেখার কোন আগ্রহই তার তৈরী হতো না। অথবা এমনও হতে পারে যে, আমার জন্য তার ভালবাসা এতটাই উতলা করে রেখেছিল যে, আমি তাকে কতখানি ভালবাসি তা দেখার কথাই তার কখনো মনে হতে পারে নি।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, তার ভালবাসা আমার প্রতি এতটাই অন্ধ ছিল যতটা আমার ভালবাসা তোমার জন্য। কিন্তু শুধু একজায়গায় পার্থক্য- তার অন্ধ ভালবাসায় আমি আমাকে ধন্য করেছি, তার ভালবাসায় আমি আমাকে আপ্লুত করেছি, তার ভালবাসা আমার ভালবাসার সাথে মিলে গেছে। কিন্তু আমার ভালবাসা তোমাকে আপ্লুত যে করে তা শুধু তুমিই বলতে পারবা, আমার ভালবাসার সাথে তোমার ভালবাসার মিলন ঘটে কি না তা তুমিই বলতে পারবা। সত্যি সত্যিই যদি তুমি আমাকে তোমার চাওয়ার পর্যায়ে নিতে না পার তবে আমি অবশ্যই আশা করি না যে আমার এই লেখনি তোমাকে তা নেবে। আমি তা চাইও না। আমার ভালবাসা যদি তোমাকে আমার করতে না পেরে থাকে তবে, আমার লেখনি দিয়ে তোমাকে আমি আমার করে পেতে চাই না। এ লেখনী শুধুমাত্র আমার ভালবাসাকে রোমন্থনের জন্য- আর কিছুর জন্য নয়।
সোহানা এবং আমি আমাদের না বলা কথার মাধ্যমে যা বলে দিয়েছি উভয়কে তার কোন বানান হয় না। তার লেখার জন্য কোন বর্ণমালা এখনও তৈরী হয় নি। তা প্রকাশ করার জন্য কোন ভাষা আজও মানুষ শেখে নি। হিসাব করে করে তিল তিল করে গড়ে উঠা কোন কিছুর প্রাপ্তিতে বিজয়ের আনন্দ আছে, মনের প্রশান্তি আছে, পাওয়ার তৃপ্তি আছে অবশ্যই। কিন্তু হিসাব করার আগেই চাওয়া এবং পাওয়া যখন একই সাথে মিলিত হয় তখন তার সাথে আবেগ থাকে। এ পাওয়াকে বিজয়ের আনন্দের সাথে তুলনা করা যায় না। এ যে সেই পাওয়া যার সাথে সাথেই চাওয়া চলে সমান তালে। পায়, কিন্তু সাথে সাথে চায়ও; চায় এবং সাথে সাথেই পায়। কোনটারই সমাপ্তি হয় না। চাওয়ার পরে যা পায় তার সমাপ্তি পাওয়ার মধ্যে। কিন্তু চাওয়া এবং পাওয়া যখন একই সাথে চলে তখন তার কোন শেষ থাকে না।
সেদিন সোহানা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমারও কি একই অনুভব যা আমার? আমি জিজ্ঞেস করলাম, আগে বলো তোমার অনুভব কি। সে বলল, মনে হচ্ছে আমার পৃথিবীতে আমি আজ নতুন জনম নিলাম। আমার এতদিনের যা কিছু তার সব আজকের যা পাওয়া তার জন্য এবং পরের দিনগুলোর যতকিছু পাওয়া তার সবকিছুও আজকের পাওয়ার উপরে।
আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল এতখানি নির্ভরতার সমাদর আমি করতে পারবোতো? এতটা নিষ্ঠার সঠিক মূল্যায়ন তাকে ফেরত দিতে পারবোতো? আমি জানি আমার ভিতরের অনুভূতি তার চাইতে ভিন্ন নয়; কিন্তু আমি ভাবছিলাম তারটার কথা, যা একান্তভাবেই আমাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে চাচ্ছে বা হওয়ার সিদ্ধান্ত অলরেডি নিয়ে নিয়েছে।
ভাললাগা, ভালবাসা এক জিনিস আর নির্ভরতা আরেক জিনিস। সেই নির্ভরতা যদি তৈরী হয় ভালবাসার উপর তবেতো তার সাথে তুলনীয় আর কিছু নাই। তার ভাললাগার বিপরীতে আমি হয়তো অনেক কিছুই করার চেষ্টা করতে পারি যা তার ভাল লাগবে। অথবা তার ভাল লাগবে আশা করে অনেক কিছুই করতে পারি বা করার চেষ্টা করতে পারি। ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসতে পারি, কঠিন কিছু না যদি আমিও তাকে ভালবাসি। কিন্তু এই যে নির্ভরতা এর সঠিক বিনিময় দেয়াতো সহজ না। ভালবেসে যদি কেউ আমার উপর নির্ভর করে তবে তার সবকিছুরইতো দ্বায়িত্ব চলে আসে আমার উপর। আর সেই দ্বায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করাই হচ্ছে তার দাবি। আমি কি পারবো সেই দ্বায়িত্ব পালন করতে? শুধু ভালবাসলেইতো সেই দ্বায়িত্ব পালন শেষ হয়ে গেল না, বরং ভালবাসার দ্বারা সেই দ্বায়িত্বের শুরু হলো।
আমি কোন জবাব দিলাম না, জবাব দিতে পারলাম না, শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল, বলছো না যে কিছু? তখন আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, আমার অনুভব হলো, আমি কি পারবো ভালবেসে আমার প্রতি তোমার এই অগাধ নির্ভরতাকে যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠা করতে, যা আমার প্রতি তোমার এই অনুভূতিকে আরও বলিষ্ঠ করবে।
সোহানা তার জবাবে বলল, দ্বায়িত্ব শুধু তোমার নয়, আমারও। চাওয়া শুধু আমার নয় তোমারও। আমার এই নির্ভরতা আমাকেও দ্বায়িত্বশীল করে তুলতে শেখাবে তোমার প্রতি যেমন, তেমন আমার নিজের প্রতিও। যদিও দুজন দুজনকে ভালবাসার কথা এখনও আমরা কেউ মুখ দিয়ে ওভাবে প্রকাশ করিনি প্রকাশ করিনি আমাদের সামনে, কিন্তু প্রকাশ না করেও যা প্রকাশ করেছি তা কথার মাধ্যমে প্রকাশের চাইতেও অনেক বেশী। এখন মুখে বলতে বাধার কিছু নাই। কিন্তু হৃদয় দিয়ে যা বলা হয়ে গেছে তা বানান করে প্রকাশ করারও কোন মানে আমি দেখি না। তবে হৃদয়ের কথা একদিন না একদিন মুখেও অবশ্যই চলে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
আমি বললাম, আমরাতো মুখে বলার বা শোনার জন্য অপেক্ষা করি নি, যখন একে অপরের হৃদয়ের অভিব্যাক্তি প্রকাশ হয়ে গেছে। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ এই কথাটা অতি পুরাতন, কিন্তু এর আবেদন সব সময়ই নতুন। সম্ভবত পৃথিবীতে এই কথাটা যত বেশী বার বলা হয়েছে অন্য কোন কথা ততবার বলা হয় নি। কিন্তু তারপরেও এর আবেদন এতটুকু কম হয় না। আমি তোমার মুখ থেকে ঐ পুরাতন কথাটা আমাদের জীবনে প্রথম বারের মতো শোনার জন্য অপেক্ষা করবো সঠিক সময়ের। আর আমিও এই বিশেষ কথাটা বলতে অপেক্ষা করবো সঠিক সময়ের।
3 comments:
মনের কথা গুলো বলে দিয়েছো ভাই
কেরামত
ধন্যবাদ আপনাকে
Post a Comment