এই কথাগুলো আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলি নি, যা আজ তোমাকে বলছি। কারণ এগুলো হলো আমার একান্ত কথা, আমার একান্ত অনুভূতির কথা। এগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে মনোরম সঞ্চয়। আমি আমার বিগত জীবনে যা পাই নি তার সমস্ত ব্যথা ভুলিয়ে দিয়েছিল আমার এই দিনগুলো। আমার অতীত নিয়ে যে অভিযোগ ছিল তা মুছে দিয়েছিল। জীবনের সৌন্দর্য, বেঁচে থাকার মাধুরতা আমাকে আপ্লুত করেছিল। অর্থনৈতিক দৈনতাকেও আমি ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম এ কারণে যে, তা না হলে লজিং-এ যাবার প্রয়োজন হতো না, আর সেখানে না গেলে আমার জীবনে এই মনোরম দিনগুলো আসার সুযোগ পেত না।
আমি দেখেছি সেই সময়গুলোতে পৃথিবী কত সুন্দর। আমি দেখেছি, প্রতিটা সকাল কত সুন্দর, প্রতিটা গোধূলীবেলা কত মনোহর। নিঝুম রাত্রির যে কি অপরূপ রূপ তা আমি অনুভব করেছি আমার হৃদয় দিয়ে। একেলা বিকেলে বিশাল আকাশের নীচে প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্বের মাঝে যে কি গভীর অভিব্যক্তি তা আমাকে আত্মহারা করেছে। আমি হেসেছি, গেয়েছি আর অনুভব করেছি চুপিচুপি একান্ত নিজের মনে। অনুভব করেছি
আমাকে, আমার চাওয়াকে এবং আমার পাওয়াকে। আমার দিনগুলো আমাকে স্বপ্নের অনুভব দিয়েছে যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।আমার কথা শুনে তুমি কি ভাবছো যে আমার অনুভবে যাকে আমি পেয়েছি তাকে বাদ দিয়ে কেন তোমাকে আবার আমার অনুভবে পেতে চাচ্ছি? তুমি কি ভাবছো, দুটোর যে কোন একটা মিথ্যা অথবা দুটাই মিথ্যা? আমি জানি তোমার মনে এমন একটা প্রশ্ন আসতে পারে। তা জেনেও আমি তোমাকে আমার সকল কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবটা শোনার পরে আমি আশা করি তোমার এই প্রশ্ন আর প্রশ্ন থাকবে না। যে প্রশ্ন এখন তোমার মনে খুব স্বাভাবিকভাবেই এখন চলে আসছে তা আর আসার সুযোগ পাবে না। এই পৃথিবীতে কোন কিছুই শূন্য থাকে না- সবকিছুই কিছু না কিছু দ্বারা ভর্তি। যদি বলা হয়, কারো শূন্যতা আমাকে বেদনায় মুষড়ে দিয়েছে তার অর্থ সত্যিকার অর্থে এই যে, আমার হৃদয়ের যে যায়গাটুকু জুড়ে কেউ ছিল সেই যায়গাটা এখন অধিকার করে আছে বেদনা; যেহেতু সে সেখানে নাই। এই বেদনাকে সরিয়ে যদি তুমি অন্যকিছুকে ওখানে বসাতে পারো তবে দেখবে বেদনা আর নাই। এই অন্যকিছু হৃদয়ের বেদনাভরা যায়গার যতটুকু অধিকার করতে পারবে বেদনার অনুভব ততটুকুই কমে যাবে।
একটা কথা তোমাকে আমি বলি, পারলে মনে রেখো। গল্প-উপন্যাস, সিনেমা-নাটকের প্রেম-ভালবাসা, এর প্রকাশ এবং অভিব্যাক্তি বাস্তবতা থেকে আলাদা। গল্প-উপন্যাসের ভালবাসাকে লেখক সমাপ্তির দিকে নিয়ে যায় নিজের প্ল্যান মাফিক। কিন্তু বাস্তবের প্রেম-ভালাবাসা প্ল্যানমাফিক হয় না, যা হওয়ার তাই হয়। যা হয়ে যায় তার উপরে আর কিছুই করার থাকে না।
আমি তোমাকে প্রথমেই বলেছি, আমি তোমাকে ভালবাসি তোমাকে নিয়ে বাঁচার জন্য, তোমার ভালবাসায় নিজেকে সিক্ত করার জন্য এবং আমার ভালবাসায় তোমাকে পূর্ণ করার জন্য। কিন্তু তোমার ভালবাসার জন্য আমি মরতে রাজী নই। অর্থাৎ তোমাকে ভালবাসলেও আমি আমার বাস্তবতাকে ভুলে যাই না। আমি ভুলে যাই না আমার জগতকে। কারণ তোমার ভালবাসা আমার জন্য অতি মূল্যবান সন্দেহ নাই; কিন্তু সব অবশ্যই নয়। তোমার ভালবাসার জন্য প্রয়োজনে তোমাকে নিয়ে কুড়ে ঘরে দিন কাটাতে রাজি আছি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে। কিন্তু তোমার ভালবাসার পরীক্ষা দেয়ার জন্য ট্রেনের নীচে লাফ দিয়ে পড়তে রাজী নই। আমাদের ভালবাসা যেন আমাদেরকে মহিয়ান করে, নীচে না নামায়। আমাদের ভালবাসা যেন আমাদেরকে আমাদের দ্বায়িত্ব থেকে সরিয়ে না দেয়। বাস্তবতার নিরীখে যেমন আমাদের জীবন চলে, ভালবাসাও চলতে হবে আমাদেরই বাস্তবতার নিরীখে।
আমি সোহানাকে ভালবেসেছি, তাকে চেয়েছি, সে আমাকে চেয়েছে, ভালবেসেছে। আমাদের ভালবাসায় আবেগ ছিল অবশ্যই, কিন্তু সে আবেগ নিজেদেরকে ভুলে গিয়ে নয়। আমি এখন তোমাকে চাচ্ছি এর অর্থ এও নয় যে আমি তাকে ভুলে গেছি বা তার অনুভব আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট নাই। আবার এর অর্থ এও নয় যে, যদি তার অনুভব, তার ভালবাসা, তার আবেদন এখনো আমার মধ্যে বাস করে তবে তোমার প্রতি আমার যে ভালবাসা তার কোন মূল্য নাই।
পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে কত না ভালবাসে। একটা সময় পর্যন্ত মানুষ নিজেদের নিয়ে ভাবলেও বা করলেও একটা সময় অবশ্যই আসে যখন তাদের সমস্ত ভাবনা এবং প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত হয় সন্তানকে ঘিরে। যে পিতা ডাইনিং টেবিলে রাখা পানি ভর্তি জগ থেকে নিজে ঢেলে পানি খান না, অনেক ক্ষেত্রে সেই পিতাই সন্তানের বায়নার প্রেক্ষিতে গভীর রাতে অনিশ্চিত জেনেও আইসক্রীমের খোঁজে রাস্তায় বের হন। কেন তা করেন? সন্তানের প্রতি ভালবাসা, আবেগ, অনুভব সবকিছুর জন্যই। এই সন্তানই যদি কোন কারণে তাদেরকে ছেড়ে কখনো চিরদিনের জন্য বিদায় নেয় তবে তার পিতামাতার বুক ভেঙে যায়, দুনিয়ার অর্থ হারিয়ে যায়, কান্নায় অথৈ সাগর বাহিয়ে দেয়। কিন্তু এই পিতা-মাতাই একটা সময় পরে তাদের জীবনকে চালিত করে, খাওয়া-দাওয়া করে, কাজ-কর্ম করে, সময়ের প্রেক্ষিতে আরও কত স্বপ্ন দেখে- জীবনে গতিশীলতা আবার ফিরে আসে। তার অর্থ কি এই যে, পিতা-মাতা তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ভূলে গেছে, তার প্রতি তাদের ভালবাসা হারিয়ে গেছে? জীবনের বাস্তবতাকে অস্বীকার কে করে বা কে কবে কাকে করতে বলে?
বিপরীতভাবে যদি একটি বাচ্চার কথা ভাবো তবে পৃথিবীতে যখন সে আসে তখন সে কোন কিছুর সাথেই পূর্ব পরিচয় নিয়ে আসে না। এমনকি হয়তো বা মায়া-মমতা, ভালবাসা কি তারও কোন ধারণা তার থাকে না। এই অপরিচিত পৃথিবী তাকে কিভাবে গ্রহণ করবে বা সে কিভাবে থাকবে তা তার জানা থাকে না। এই না জানার কারণে যে বাস্তবতায় সে নিজেকে সম্পূর্ণ এক নতুন পরিবেশে দেখে তাতে সে ভয় পেয়ে যায়। যার ফলেই সে তীব্র স্বরে কেঁদে উঠে। নিজেকে অত্যন্ত অসহায় দেখতে পায়। কিন্তু একটু পরেই মমতাভরা স্পর্শ যখন তাকে আপন করে নেয় তখন সে স্বস্তি পায়। সে বুঝতে পারে অপরিচিত হলেও অনাকাংখিত নয়। আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারে ভালবাসা, মায়া-মমতার আধার মা তাকে কতটা আগলে রাখে। তখন সে মা ছাড়া আর কাউকে বোঝে না। কিন্তু কোন কারণে যাদের মা তাদের জীবনের প্রথম মূহুর্তেই বিদায় নেয় তারা কি বেঁচে থাকে না? তাদের সামনের দিনগুলো কি থেমে যায়? কষ্টের হয় অবশ্যই, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় না। সে জগতে বড় হয়, সমাজের একজন হয় এবং নিজের জীবনকে সামলে নিতে শেখে। হাসে, কাঁদে, করণীয় যা তার সবই করে। এর অর্থ কি এই যে, তার জীবনে তার মায়ের প্রয়োজনটা একেবারেই গুরুত্বহীন ছিল বা গুরুত্বহীন হয়ে গেছে?
সবকিছুর আলাদা আলাদা আবেদন থাকে। মায়ের আবেদন মায়ের মতো, বোনের আবেদন বোনের মতো। ভাই বা পিতার আবেদন এর থেকে ভিন্ন। কিন্তু কারোটাকে কারোটার কাছে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নাই। জাগতিক কারণে একের আবেদন অন্যের থেকে ভিন্নতা পেলেও একটা দিয়ে আরেকটাকে খাট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। মা যেমন বুকে আগলে রাখেন, পিতা তেমন মাথার উপরে ছাতা হয়ে থাকেন। বোনের মমতা আর ভায়ের ভালোবাসার রূপের পার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু তাদের আবেদন নিজ নিজ স্থানে উজ্জ্বল। বোনের মমতা পেয়ে ভায়ের ভালবাসাকে উপেক্ষা করে না কেউ আবার ভায়ের ভালবাসা যেখানে কার্যকর বোনের মমতার সেখানে কোন আবেদন নাই এমনটি কেউ কখনো ভাবে না।
তুমি কি একথা বলবা যে, গল্প-উপন্যাসে, চলচিত্র-নাটকে অন্যভাবে বলে, অন্যভাবে লেখে? আমি জানি। তুমিও হয়তো জানো যে, লেখক মানুষের আবেগকে সাথি করে লেখে। যখন কোন ঘটনা পাঠক পড়ে অথবা ছবির মাধ্যমে দেখে তখন খুব অল্প সময়ের মধ্যে সবটুকু পড়া বা দেখা হয়ে যায়। আবেগ অনুভূতি যা থাকে তা সবই একটা স্বল্প সময়ের আবর্তে। সেই স্বল্প সময়ের মাঝে পাঠক বা দর্শকের আবেগ কি চাইতে পারে বা কি পছন্দ বা অপছন্দ করবে তার দিকে খেয়াল রেখে ঘটনাকে সুন্দরভাবে নিজের মতো করে সাজায় এবং এই সাজাতে গিয়ে আবেগকে উদ্বেলিত করার মতো এমন সব দর্শনকে সামনে নিয়ে আসে যা শুনতে বা পড়তে খুবই আকর্ষনীয় লাগে। প্রেমের কথা লিখতে গেলে প্রেমকে মহিয়ান অথবা প্রেমের জন্য মহিয়ান বানানোর জন্য ঘটনাকে এমনভাবে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া হয় অথবা বিসতৃতির দিকে নিয়ে যাওয়া হয় যা বাস্তব জীবনের দর্শনকে পাশ কাটায়।
আমি তোমাকে যা বলছি, তা আমার বাস্তবতার নিরীখে। আমি যে ভালবাসার কথা বলছি, তা আমার বাস্তবতার নিরিখে। যে ভালবাসা আমাকে, তোমাকে বা সোহানা কাউকেই অস্বীকার করে না, অবজ্ঞা করে না আমাদের কারো আবেগ এবং অনুভব বা অনুভূতিকে। আমাদের বাস্তবতাকে কাল্পনিক দর্শনের কিতাবী থিওরীর অন্তরালে মোড়কবদ্ধ করে না।
এখন বলো তুমি কি আমার জীবনের বিশেষ অধ্যায়ের বাকী অংশটা শুনবা, নাকি এখানেই বন্ধ করে দেব? তুমি যদি না চাও তবে এখানেই স্টপ করে দিতে পারি। আমার জীবনের গল্প আমার কাছেই থাক, যাকে আমি একান্তভাবে লালন করে চলেছি দীর্ঘ দিন যাবৎ।
না, না; আমার মনে হয় তোমাকে বলা দরকার পুরোটাই। যেহেতু তুমি অনেকখানিই জেনে গেছো, এখন বাকীটা যদি তোমাকে না বলি তাহলে তোমার মনে প্রশ্ন রয়েই যাবে। আমি তোমাকে অন্ধকারে রাখতে চাই না। তোমার মনকেতো আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। কিন্তু আমি চাই না তুমি না জেনে আমার সম্পর্কে কোন ধারণা পোষণ করো, যা হবে ভুলে ভরা।
No comments:
Post a Comment