আমরা আমাদের জীবনে অনেক কিছুকে আপন করে পাই যেখানে আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। প্রত্যেকটা ভাল মনের মানুষ তার জন্মভূমিকে একান্ত আপন করে নেয় প্রকৃতিগতভাবেই। পৃথিবীর কোন্ জায়গাটা তার জন্মভূমি হবে, কোথাকার আলো-বাতাসের সাথে খেলা করে সে বড় হবে এবং মনের দিক থেকে তাকে একান্তভাবে নিজের করে নেবে তা তার নিজের পছন্দের ভিত্তিতে হয় না। কিন্তু যে যেখানে জন্মে, বড় হয় সেটাই তার প্রিয় জায়গা, যেমনভাবে তার মা তার কাছে প্রিয় সবার চাইতে- সে গোরা হোক অথবা কাল।
আমি চলে এলাম আমার ভাগ্যের অন্বেসনে, আমি চলে এলাম আমার সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে অনেক দূরে। আমি বিদায় নিলাম আমার চির চেনা প্রেমময় পৃথিবী থেকে, অপরূপ সুন্দর আমার জগত থেকে। যে আলো-বাতাস-হাওয়া আমার একান্ত আপনার হয়ে আমাকে লালন করেছে এতদিন।
আমাকে আজ ছাড়তে হবে আমার প্রিয় মানুষগুলোর সাঙ্গ, প্রিয় জায়গা। আমার হৃদয়ে তখন ছেড়ে যাওয়ার বেদনা।
বিদায়ের সময় যত এগিয়ে আসতে লাগলো সব হারানোর বেদনাও তীব্র হতে লাগলো। কিন্তু আমি জানতাম না এরও চাইতে বেশী তীব্রতা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমার মনে হচ্ছিল আমি হারিয়ে যাচ্ছি সবার থেকে। যে আলো-বাতাসের সাথে মিলে মিশে রয়েছে আমার সকল অস্তিত্ব তাকে যেন আমি আজ হারাতে বসেছি। কে জানে কতদিন গ্রামের বাড়ি গিয়ে আর আমি আমার চির পরিচিত মেঠো পথ ধরে হাঁটতে পারবো না। যে পথের উপরে বিছানো রয়েছে শুকনো পাতার মখমলের গালিচা, যা পায়ের নীচ থেকে মৃদু মচমচে আওয়াজে ভালবাসার কথাগুলোকে একনাগাড়ে বলে যেতে থাকে।
আমি যদি সারাটা দিন-রাত্রিও অপেক্ষা করে থাকি তবুও আর তোমার পায়ের মৃদু ধ্বনিত নূপুরের আওয়াজ আমার চেতনাকে সহসা আনন্দে হিল্লোলিত করতে পারবে না। বাসার পাশের ছোট্ট গাছটিতে বসে শিষ দেয়া ছোট্ট পাখিটির আওয়াজের ধ্বনির সাথে মিশে তোমার আপন মনে গেয়ে যাওয়া গানের ছোট ছোট কলিগুলোর অনুভব আর আমাকে পাগল করতে আসবে না। অনেক দিন (২/৩ দিনের বেশী অবশ্যই নয়) পর্যন্ত তোমাকে না দেখার কারণে তোমার প্রতি জমা হওয়া অভিমানগুলোকে প্রকাশ করার জন্য তোমাকে আর আমি সামনে পাবো না। আমার অভিমানের জবাবে তোমাকেও আর আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিতে হবে না। যে আমি তোমাকে মাত্র কয় দিন না দেখলে হৃদয়ে অস্থিরতা অনুভব করতাম সেই আমি দিনের পর দিন তোমাকে না দেখে, তোমার সাথে কথা না বলে, তোমার সান্নিধ্যের পরশ থেকে দূরে থেকে কিভাবে বেঁচে থাকতে পারবো আমি জানি না।
এই সমস্ত নিত্য দিনের সংঘটিত কর্মকান্ড, অনুভব, অনুভূতি আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করে দিতে থাকলো। বাড়ি থেকে বের হবার সময় ঘনিয়ে আসতে থাকলো। সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। মন যাকে সবচাইতে বেশী করে চাচ্ছে তার দেখা নাই। দরজায় নক হলেই মনের ভিতরের উতলা অনুভূতি উন্মূখ হয় দেখতে কে এলো, যদিও আমি জানি এ তুমি নও। তুমি যদি দরজায় নক করো আমি তা অবশ্যই বুঝতে পারবো- কত দিনের পরিচিত আমার কাছে। তুমি নক করলে দরজার এপার থেকে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন নাই তুমি কে। আমিতো জানিই তুমি কে।
পল পল করে সময় চলে যাচ্ছে। দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটা টিক টিক শব্দে সময় মেপে মেপে বলে দিচ্ছে আমার বিদায়ের বারতা। বেরোতে হবে আমাকে- অপেক্ষার সময়ও শেষ হয়ে এলো, যদিও সবাই বলে অপেক্ষার সময় নাকি ফুরাতে চায় না। সবকিছুই শেষ হয়ে যায় এক সময়। যা কিছু শুরু হয়, তার সবই এক সময় শেষ হয়ে যায়। শেষ হয়ে যাওয়াই শুরুর অবশ্যম্ভাবি পরিণতি। আমার অপেক্ষাও শেষ হয়ে গেল। বেরিয়ে পড়লাম বাইরে অপেক্ষমান গাড়ির উদ্দেশ্যে যা আমাকে নিয়ে যাবে আমার বিদায়ের শেষ প্রান্তে।
যারা যারা যাবে আমার সাথে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত তারা সবাই উঠে বসেছে গাড়িতে। আমি তখনও শেষবারের মতো রাস্তার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে এলাম আমার বেদনাহত চোখের দৃষ্টি দিয়ে, ভেঙে পড়া আশা বুকে নিয়ে, ঐ বুঝি তুমি এসে গেলে হন্ত-দন্ত হয়ে এবং এসেই কান্না ভাঙা গলায় আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে আমার দিকে চেয়ে বললে, স্যারি ফর দা লেট। আমি আপনাকে ভিষণ মিস করবো। প্লিজ কেমন থাকেন জানিয়ে চিঠি দিয়েন। হয়তো বা আরও বেশী কিছু, যা এতদিন আমাকে বলতে পারনি। হয়তো বা এমন কিছু বলবে, যা হবে আমার জন্য তোমার পক্ষ থেকে সবচাইতে বড় উপহার বিদায়ের প্রাক্কালে, যা আমাকে তোমার থেকে দূরে থাকার বেদনাকে ভুলিয়ে দেবে যখন আমি তোমাকে তীব্রভাবে মিস করবো।
কিন্তু না, তুমি এলে না। বার বার আমার মনে হলো, তুমি পারলে! কিভাবে তুমি পারলে! বুকের ভিতর থেকে গভীর বেদনার এক তীব্র আঘাত কান্না হয়ে বের হয়ে আসতে চাইলো। আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম হৃদয় বিক্ষুদ্ধ কান্নাকে রোধ করার জন্য। উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি ছেড়ে দিল। শেষ বারের মতো পিছনের দিকে ফিরে চাইলাম। কিন্তু না, অনেক মানুষের আনাগোনা নজরে এলো, তুমি নাই তাদের মধ্যে। আর রোধ করতে পারলাম না কান্নাকে, যা অনেকক্ষণ যাবত আমার ক্ষণে ক্ষণে দূর্বল হয়ে যাওয়া মনের কিনারে আঘাত করছিল। গড়িয়ে পড়তে লাগলো হৃদয়ের কান্নাগুলো চোখের পানি হয়ে। ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হলো হৃদয়ের ভিতরটা।
আমার জীবনের প্রথম প্লেন জার্নি এটা। আগে অনেকবার এয়ারপোর্টে গিয়েছি বিমান দেখতে, বিমান-বন্দর দেখতে। অনেক আগ্রহ নিয়ে গিয়েছি, কিন্তু যা দেখেছি তা শুধু বাইরে থেকে। বাইরে থেকে গ্লাসের ভিতর দিয়ে যতটুকু সম্ভব দেখার চেষ্টা করেছি ভিতরের সবকিছু। প্রশমন হয়নি আগ্রহের। বিমান উড্ডয়নের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো শত আগ্রহ স্বত্ত্বেও, যা দেখেছি তা হলো প্লেন উড্ডয়ন শেষে আকাশের পানে উড়তে শুরু করার পরে দূরে থেকে। আশা মেটে নি, রয়ে গেছে দেখার আগ্রহ। মনে হয়েছে কত ভাগ্যবান যারা এই কাঁচের দেয়ালের ওপারের জগত দিয়ে নীল আকাশে উড়াল দেয় ডানায় ভর করে উড়ে চলা বিমানে করে। মনে হতো এমন একটি সুযোগ যদি আমার জীবনে আসতো!
আজ এসেছে সেই বহু কাঙ্খিত সুযোগ। আমি আজ অনায়াসে চলে যেতে পারলাম কাঁচের দেয়ালের ওপারের সাজানো জগতে। কিন্তু কোথায় আমার সেই আগ্রহ? আমি না কত আগ্রহ নিয়ে ভিতরের দিকে দেখতে চেষ্টা করেছি আগে, আজ কেন সেই আগ্রহ নাই সবকিছুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার?
আমার সবকিছু ছেড়ে আমাকে যেতে হচ্ছে অন্য এক জগতে যেখানে আমার কেউ নাই- এটা একটা কষ্টের। কিন্তু এ কষ্ট অতটা বেশী তীব্র নয়- কেননা, এটাতো বেছে নেয়া সিদ্ধান্ত, যদিও প্রয়োজনই এ পথে পা বাড়াতে বাধ্য করেছে। কিন্তু প্রধান যে কারণে সবকিছুর প্রতি অনাগ্রহের আস্তরণ পড়েছে সেটা অন্য কারণ আর তা হলো- তুমি।
মানুষ মরে যাবার আগে আশা করে তার মৃত্যুতে অন্তত কান্না করার মতো কেউ থাকবে- দুঃখে ব্যাথিত হবার মতো কেউ থাকবে। বিদায় নেয়ার আগে আশা করে তার বিদায়ের পথ পানে চেয়ে অন্ততঃ প্রিয় দুটি চোখ বেদনার অশ্রুতে সিক্ত হবে, চলে যাবার পর পথ চেয়ে থাকবে ফিরে পাবার আশায়। কিন্তু যার কান্নাভেজা চোখের পানে চেয়ে হৃদয়ে ভালবাসার ঘরটি মজবুত হবে সে চোখ কোথায়?
যাকে আমি আমার হৃদয়ের ঝংকার হিসাবে দেখতে ব্যাকুল হই, যার উপস্থিতি আমার জন্য খুশির আর অনুপস্থিতি বেদনার, যার হাসি আমার জন্য আনন্দের আর বেদনা হলো বিমর্ষ তার এ কেমন আচরন? তোমাকেতো আমি আমার হৃদয় স্পন্দন হিসাবেই জেনেছি সব সময়। তুমি যখন থাকো না, তখন এই স্পন্দনকে নির্জীব পড়ে থাকতে দেখেছি আবার তোমার সামান্য উপস্থিতি ঐ নির্জীব স্পন্দনকে জাগিয়ে তুলে সতেজ করেছে সর্বদা। আজ সেই তুমি যখন আমার বিদায় বেলায় দেখাটি পর্যন্ত করতে এলে না তখন আমার সামনে আকর্ষণীয় রূপ নিয়ে যত কিছুই হাজির হোক না কেন কি তার মূল্য?
স্বপ্ন-সুন্দর (আমার কাছে, যে এর আগে কখনো দেখে নি) এয়ার পোর্টের আধুনিক সাজ সজ্জা আমাকে একটুও আকর্ষণ করতে পারলো না। বাইরে অপেক্ষমান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভিতরে গিয়ে প্রয়োজনিয় ফর্মালিটিজের বাইরে পুরো সময়টা নিরাশক্তের মতো দাঁড়িয়ে অথবা বসে থাকার বাইরে আর কিছুই করি নি। এভাবে এক সময় আমাদের জন্য অপেক্ষমান সৌদী এয়ার লাইন্সের আধুনিক ফ্লাইটটিতে গিয়ে নির্দিষ্ট সিটে বসে পড়লাম।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, কেন আমি মনের দিক থেকে এত দূর্বল? কেন আমি এমন কারো জন্য বেদনায় জর্জরিত হচ্ছি যার মধ্যে আমার ব্যাপারে কোন অনুভূতিই কাজ করে না। কাজই যদি করতো তবে বিদায় মূহুর্তে আমাকে না দেখে কিভাবে থাকতে পারলো?
আমি প্রায় সারাটা সময় বিষন্নতার এক কালো চাদরে নিজেকে মুড়ে চুপচাপ বসে ছিলাম আমার সিটে। আমার পাশের প্যাসেজ দিয়ে বিভিন্ন যাত্রীসহ এয়ার হোস্টেসরা বার বার যাতায়াত করছে। প্লেনে উঠার অল্প সময় পরে এয়ার ফোন দিয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পরে হাত মুখ মুছে ফ্রেশ হবার জন্য রুমাল দিল। তার কিছুক্ষণ পরে চকলেট দিলো। তারও কিছু সময় পরে লাঞ্চ দিল। সব শেষে জেদ্দা এয়ার পোর্টে প্লেন ল্যান্ড করার কিছু আগে জুস দেয়ার সময় এক এয়ার হোস্টেস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার মুখ আমার মুখের মতো করে ভ্যাঙালো এবং পরক্ষণেই হেসে দিল। কারণ প্লেনে উঠার পর থেকেই সে ফলো করেছে আমি একেবারে নিরাসক্ত হয়ে মুখ ভার করে বসে রয়েছি। তার অভিনয়ের জবাবে আমিও হেসে দিলাম এবং বললাম, স্যারি। সে বললো, why do you look so sad?
- I have lost my dream, that’s why. আমি তার দিকে কিয়দক্ষণ তাকিয়ে বললাম।
- oh! really?
- yes, but I should not show that to all. I realize now, thanks. আমি তার হাত থেকে জুসের গ্লাস নিতে নিতে বললাম।
Hope everything will be okay again. বলে সে চলে গেল। আমি তার কোন জবাব দিলাম না। শুধু মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম- আর কাঁদবো না তোমার জন্য। আর হাসবো না তোমাকে দেখে, ডাকবো না আর তোমার নাম ধরে কখনো।
No comments:
Post a Comment