Welcome Text

Welcome you to read daily important topics, quotes, discussion or news. You can share your comments or even new topics you like to be seen by the world

দিন শুরু অপেক্ষার

জৈষ্ঠ মাসের গরমের রাত- আমরা তিন-ভাইবোন ঘরের সামনে উঠোনে পাটি বিছায়ে হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করছি। আমাদের সাথে ভাইও থাকে প্রতিদিন; আজ নাই। ছোট ভাইকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। এভাবেই কেটে গেছে অনেকটা সময়। গ্রামের সন্ধ্যা- চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার একটানা গেয়ে চলার আওয়াজ যেন থামবার নয়। কুকুরটা আমাদের অদূরে বসে আছে; অপেক্ষা করছে কখন আমাদের খাওয়া-দাওয়া শুরু হবে- তার ভাগেরটা সে আদায় করে পরে আবার আশে-পাশের বাড়িতে গিয়ে কিছু পাবার চেষ্টা বে। অথবা হয়তো অন্য বাড়ি থেকে তার প্রাপ্য অংশটা নেয়া শেষ হয়ে গেছে এবং এখন এখানে অপেক্ষা করছে। কারণ আমাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া আশে-পাশের বাড়ি থেকে একটু দেরীতেই হতো। খাওযা-দাওয়ার পরে আমাদের আর পড়া হতো না- ঘুম এসে যেতো পড়তে গেলে।
মা বেঁচে থাকতেও গরমের সন্ধ্যায় আমরা এভাবে উঠানে খেঁজুর পাতার পাটি বিছায়ে পড়তে বসতাম। আমি পড়াশুনায় বরাবরই দূর্বল ছিলাম-
পড়তে বসলেই ঘুম আমাকে কাবু করে ফেলত। যা বলে দিত তা পড়তে থাকতাম, কিন্তু বুঝতাম না কি পড়ছি। মা মারা যাবার পরে খুব বেশী দিন পার হয় নি। কিন্তু আমাদের জীবন থেমে যায় নি, থেমে যায়নি জীবনের দৈনন্দিন কাজগুলো। মায়ের লাশের উপর ভায়ের আছড়ের পড়া কান্না এখন আর নাই- যদিও কান্না তখও থামে নি। আমরা কাকে মা বলে ডাকবো বলে চিতকার করা বোনেদের কান্নার আওয়াজ আজ আর চারদিক অতটা বিদীর্ণ করে না, যা করে তার অন্তরকে। মায়ের মমতাময়ী স্পর্শধন্য বাড়ির সবকিছুরই অন্তর যেন বিদীর্ণ। আর তাই আগের নিয়ম অনুযায়ী উঠানে বসে বইগুলোকে সান্নিধ্য দেয়া ছাড়া পড়া যাকে বলে তা কারোরই হচ্ছিল না।
হঠা আমাদের সদর দরজা দিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে দুই বাড়ি পরে রাস্তার ধারের বাড়ির আমার চাচাত বোন (দাদার ভায়ের নাতনী) দৌড়ে এসে বলল, এই বেবী! তোর মা এসেছে। সবার সামনের খোলা বইগুলোকে ওভাবেই রেখে দরজার দিকে তাকালাম তাকালাম, কিন্তু তার কথা আমার বিশ্বাষ হলো না। আমার মনে হলো, আমার মাকেতো কাঁঠাল বাগানে কবরে শুইয়ে রেখে আসা হয়েছে। আমার মাতো মারা গেছেন। মা আসবেন কিভাবে? খুব বেশী সময় পার না হলেও তার খবর দেয়ার পরে আমার চিন্তা ঘুরপাক খেতে শুরু করে দিয়েছে। মরে গেলে কি কেউ ফিরে আসে নাকি? এই কয়দিনে এটুকুন বিশ্বাষ আমার দৃঢ় হয়ে গেছে যে, যিনি মা মারা গেছেন, তিনি আর কখনো ফিরে আসবেন না। আমি চিন্তা করছি, আর একটা অবিশ্বাসের আশা আমার ভিতরে কাজ করছে- সত্যিই যদি আমার মা আসে। দেখতে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে; কিন্তু আমার বড় দুই বোনের কেউ যাচ্ছে না, আমি কিভাবে যাই? তারা যাচ্ছে না, কারণ তারা জানে এই ‘মা আসার’ অর্থ।
পাশের বাড়ি থেকে সেজো দাদী (দাদার সেজো ভাইয়ের বৌ) প্রবেশ করেই আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, এখনও বই নিয়ে বসে আছিস? আর পড়া লাগবে না, বই-খাতা ঠিয়ে রাখ। আমার দাদী অনেক আগেই মারা গেছেন। আমরা উঠে পড়লাম বই খাতা নিয়ে এবং ঘরে গিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলাম।
টকটকে লাল শাড়িতে ঢাকা এক মহিলাকে সাথে নিয়ে আব্বা সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। সাথে আশে-পাশের অনেক লোকজনও আসতে থাকলো- ছোট বড় সব। দাদীর নির্দেশে ঘরে থেকে চেয়ার এবং বেঞ্চ নামানো হলো- তাদেরকে বসতে দেয়া হলো। দাদী আমাদেরকে বলল, সালাম করতে। তখনতো বুঝি না যে, পা ছুয়ে ছালাম করার যে কি মানে তাতো বুঝি না তখন। আমরা ছালাম করলাম। না, মাথায় হাত দিয়ে হিন্দুদের মতো আশির্বাদও পেলাম না, আবার হাত ধরে কাছেও টেনে নিল না। ছালাম করে করে আমরা সরে দাঁড়ালাম আমরা তিন ভাই-বোন দাদী ডাকলো, শাহনূর কই? ভাই ঘর থেকে বের হয়ে এসে ছালাম করলো। কেন ছালাম করতে হবে, কেন ছালাম করলাম জানতে পারলাম না।
দাদী ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত রাকীবকে কোলে করে নিয়ে এসে মহিলার সামনে বাড়িয়ে ধরলো। যা বুঝলাম, তার কোলে দিতে চাইলো। কিন্তু মহিলার কাছ থেকে তাকে কোলে নেবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। শেষে আব্বাই দাদীর কোলে থেকে তাকে নিয়ে তার কোলের উপরে দিয়ে ধরে থাকলো। মহিলা হাত বের করলো, কিন্তু সে হাতে জোর নাই। মহিলার কোলের উপরে আব্বাকে ধরে থাকতে দেখে ভাই গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে একটু আড়ালে চলে গেল উপস্থিত নারী-পুরুষ সবার মাঝে একটা হালকা সোর শোনা গেল। দাদী মহিলার সামনে গিয়ে বললো, আজ থেকে এরা তোমার ছেলে মেয়ে। এদের মা নাই- তুমিই এদের মা, সেইভাবে দেখা শোনা করবা। এজন্যই তোমাকে নিয়ে এসেছে আব্বা। আশে-পাশে কারো কারো মুখে থেকে শোনা গেল, সেতো দেখাই গেল কেমন দেখাশোনা করবে। আমাদেরকে লক্ষ্য করে বলল, তোমাদের মা মারা গেছে- আজ থেকে - তোমাদের মা। ঠিকমতো মেনে চিনে চলবা। হ্যাঁ, কাকে মা বলে ডাকবে এই বলে কান্না করছিল আমার বোনেরা- মা বলে ডাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল কত সহজে!
মহিলা কেন রাকীবকে ধরলো না তা আমি জানি না। জানার মতো বুদ্ধিও তখন আমার থাকার কথা নয়। হয়তো বা ঘুমন্ত শিশু তার ভাল লাগে নি। অথবা তার হাতে মেহেদী লাগানো আছে, কোলে নিলে সে মেহেদী নষ্ট হয়ে যাবে। এমনও হতে পারে তার হাতে অতটা জোর নাই শিশু বাচ্চাকে কোলে তুলে নেবার মতো।
কিন্তু আসল কথা যে অন্য রকম তা আমাকে সেই সময় কে বোঝাবে? বিয়ের পরে স্বামীর ঘরে বৌ হয়ে আসার পরে যাদের সাথে প্রথম পরিচিত হতে হয় তারা হলো, শ্বশুর-শাশুড়ী, দেবর-ননদ, ভাষুর-জা, যাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ ঘরের আলো বলে কাছে টেনে নেবে, আবার কেউ কেউ দুষ্টামী-বাঁদরামী দিয়ে হাসি-খুশিতে ভরিয়ে দেবে। কিন্তু এসব কিছুর পরিবর্তে যাদেরকে তার সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে, তারা তাকে কি দেবে? প্রশ্নের জবাব হয়তো তার জানা নাই, তাই তার হাতে শক্তি আসে নি শিশু বাচ্চাকে ধরার।
এর বাইরে অন্য সবাই কি বুঝলো তা আমি জানি না। কিন্তু আমি যা বুঝলাম তা হলো, আমার ক্ষুধা পেয়েছে। পড়তে বসে আমি শুধু এই অপেক্ষাতেই ছিলাম যে, কখন খাওয়ার ডাক আসবে। অনেক রাত হয়েছে, খাওয়ার কথা কেউ বলছে না। প্রতিদিনতো আরও অনেক আগে খাওয়া হয়ে যায়। আমি ছোটবুবুকে চুপি চুপি বললাম, বুবু! ক্ষুধা পেয়েছে।
এই যে ক্ষুধা আমাকে উতলা করছে খাওয়ার জন্য এই ক্ষুধা আমার কাছ ছাড়ে নি পরের দিনগুলোতে। সব যন্ত্রণাকে পিছে ঠেলে এই ক্ষুধার যন্ত্রণাই করেছে বড় বেশী কাতর দিনকে দিন। এই কাতরতা নিয়েই পার করেছি জীবনের এক একটা দিন অতি কষ্টে। যে কুকুরটা প্রতিদিনের মতো আজও কিছু সময় আগে অপেক্ষা করছিল তাকেও আর দেখা গেল না। জানি না সে কোথায় উধাও হয়ে গেল। কিজানি সে আগে থেকেই বুঝে গেল কিনা যে, যে অপেক্ষা এতদিন পর্যন্ত প্রতিদিনই তার উদর পূর্তিতে কাজে এসেছে সে অপেক্ষা এখন থেকে আর কাজে আসবে না। তাই তার অপেক্ষার দিনও শেষ আজ থেকে। কিন্তু সে হয়তো এটা বোঝেনি যে এবং আমরাও বুঝিনি যে, আমাদের অপেক্ষার দিন আজ থেকে শুরু হলো।
ক্ষুধার যন্ত্রণা অন্য সকল যন্ত্রণাকে হার মানায়। ক্ষুধার যন্ত্রণা অন্য সকল যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দেয়। আবার বলা যায় ক্ষুধার যন্ত্রণা অন্য সকল যন্ত্রণাকে স্মরণে এনে দেয়।
ক্ষুধার যন্ত্রণা মানেই যে খাদ্যের অভাব এমনটি কিন্তু সব সময় নয়। খাদ্যের অভাব না থাকলেও বা ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার থাকার পরেও কোন কোন জীবনে এমন সময় কখনো কখনো আসে, যখন ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
কখনোই বলতে পারবা না তোমার দিনগুলো কাল তেমনই যাবে যেমন আজ যাচ্ছে। তুমি জানো না তোমার পকেটে টাকা থাকা স্বত্ত্বেও অথবা টাকার অভাবে আগামী কাল ক্ষুধার্ত কাটাতে হবে। আমার জীবনের সেই দিনগুলি কি যে এক দুঃর্বিসহঃ যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিদিন ফিরে আসতো তা তোমাকে আমি আজ বলে বা লিখে বোঝাতে পারবো না। প্রতিদিনের তিলে তিলে ভোগ করা কষ্টগুলো এতদিন পরে এসে তোমাকে কিভাবে বেঝাবো কাগজের পাতায় লিখে যখন মনে হয় আমি যেন আমার ভাই-বোনদের থেকে অনেক দূরের হয়ে গেছি। যে ভাই এবং বোন ছাড়া আর কাউকে আপন হিসাবে কাছে পাইনি কখনো, যার কাছে আমাদের সকল কথা, সব অনুভূতি, সব কষ্টের কথা বলা যায় এবং বললেও তার কাছ থেকে সেই কাঙ্খিত সহানুভূতি মিলতে পারে। আজ সেই যে একই আত্মার পাঁচ জন মনে হয় না সেই একই আত্মা আছে- ভাগাভাগি হয়ে গেছে।
আত্মা কখনো ভাগাভাগি হয় নাকি? হয়তো বা হয় না। কিন্তু একাধিক আত্মা যদি এক হতে পারে তবে তা হয়তো ভাগও হতে পারে। যদি তাই না হবে তবে কেন আগের সেই অনুভব আসে না?
আমার কি মনে হয় জানো? দূরত্ব মানুষকে দূরে নিয়ে যায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যদি সেখানে কোন চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্ন থাকে। মানবিক দূর্বলতার কারণেই তুমি যখন আমার সামনে থাক তখন তোমার সুখ-দুঃখকে যেভাবে বুঝতে পারি, অনুভব করতে পারি, দূরে চলে গেলে তা বুঝতে পারি না। যা ঝতে পারি তার কিছু হয় অনুমানের আর কিছু হয় হিসাবের। তখন হিসাব করি তুমি এই এই করলে, এই এই বললে কাজেই তুমি এমন হয়ে গেছ। অনুমানও করি আমার নিজের হিসাব মতো, নিজের চিন্তা-চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে। আর ভুলটা তখনই হয়।
সেই সময়ের আন্তরিকতার তুলনা আর হয়তো কখনো হবে না যখন সবাই সবার জন্য দুঃখী অথবা সুখী হতাম। যখন একই প্লেটের খানা সবাই মিলে খেতাম। যখন একের কষ্ট তার চাইতে বেশী করে বিঁধতো অন্যকে। নিজের বলতে সবাইকে মিলিত করে বুঝতো হৃদয়। সময় যে কেন বদলে দেয় সবকিছু! বড় কষ্টের।
মা বেঁচে থাকতে সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসার পরপরই প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা পাত্রে মুড়ি হাজির হয়ে যেত। এটা ছিল নিত্য দিনের রুটিন। মুড়ির সাথে থাকতো কোন দিন নারিকেলের নাড়ু, আখের গুড়, আগের দিন হাট থেকে নিয়ে আসা তিলের খাজা। অথবা কোন দিন মরিচ-পেয়াজ এবং ঘরের শরিষা ভাঙানো তেল দিয়ে মজা করে মাখানো। মুড়ি ছাড়া কোন একদিনের শুরু আমরা কখনো কল্পনাও করতাম না। বড়রা স্কুলে যাবার আগে গোসল করে গরম ভাত খেতো। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা ছিল ভিন্ন। গোসল করে গরম ভাত খাবার আগে আরও একবার রাত্রের বাসি ভাত-তরকারী আমার জন্য নিয়মিত। স্কুলে যাবার সময় বড় রূমালে বেঁধে মুড়ি অবশ্যই নিতে হবে টিফিন পিরিয়ডে খাওয়ার জন্য। স্কুল থেকে ফিরে এসে দুপুরের রান্না গরম ভাত।
আমাদের দেখা শোনার নাম করে যাকে নিয়ে আসা হলো, সে কেন আমাদের এই রাজকীয় নিয়ম চলতে দেবে? আমার লেখার পর্যায়ে এসে মায়ের উপস্থিতি আমাদের দিনগুলোকে কিভাবে কষ্টে ভরে দিয়েছিল তার বর্ণনা দিয়ে তোমার ধৈর্যকে ঢিলা করতে চাচ্ছি না। কারণ তুমি অবশ্যই এই জাতিয় যন্ত্রণা সম্পর্কে দেখে বা শুনে থাকবে অনেক।

No comments: